শান্ত দামোদর, পাখিদের কলকাকলি, বাড়তি পাওনা ভারতচন্দ্রের কাব্যতথ্য



পিকনিকের আদর্শ স্থান আমতার ফতেপুর

-কল্যাণ অধিকারী

আঙুলের ডগায় লম্বা সাদা সিগারেট। ধোঁয়া বের হতে হতে শেষ হবার মুখে। কাউন্টার শেয়ার করাটা যৌবনের স্বভাব। তবুও আজ ওদের এ সবে ডোন্ট কেয়ার ভাব। সকলের হাসি ঠাট্টা, দূরে ধুম ধাড়াক্কা বক্সের আওয়াজ, আর নদীর পাড়ের শীতল হাওয়া গায়ে মেখে পিকনিকের জোরদার আয়োজন ছিল ওদের তত্ত্বাবধানে। 

কিছুটা দূরে মেঠো শীতে স্রোত ভোলা শান্ত দামোদর। দু'চোখ জুড়ে দেখলে মনে হবে বড্ড শাসন করেছে কেউ দুঃখের নদীটাকে। স্নানে নামলেও পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে নদীগর্ভে টেনে নেয় না। ও পারে শীতের পাদপদ্ম মেশা সবজি ভরা বিস্তীর্ণ উঁচু চর। যেন সর্বসুখের কথা শোনাচ্ছে। এমন সুন্দরী পটভূমি ছিল একটা প্রকান্ড দিনের পরিবেশ মুখি পিকনিক স্থল আমতা'র ফতেপুর। 

ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস বাঙালির পিকনিকে মেতে ওঠার সময়। জেলার একাধিক স্থান আনন্দে আবডালে ভরে ওঠে। হাওড়া থেকে ৫২ কিমি দূরে আমতা স্টেশন। ওখান থেকে টোটোয় চেপে দুপাশের গ্রাম্য চিত্র ও বিস্কুট ফ্যাক্টরির ম ম করা সুরভি নাকে নিয়ে ৫কিমি পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন ফতেপুর। পাশের পিচ ঢালা রাস্তা এগিয়ে দেবে নিম্ন দামোদরের পাড়ে। উঁচু বাঁধে মোড়াম পাতা রাস্তায় গায়ে মাথা উঁচিয়ে ইউক্যালিপটাস গাছ। এক পাশে উন্মুক্ত ধানি জমি। অপর দিকে খড়িবন। বুনো বেড়াল, ভাম, কটাস, বাঘরোল, শিয়াল সহ বিভিন্ন বন্য জন্তুর সহবস্থান। কিছুটা এগোলেই দামোদরের কোল ঘেঁষে বল খেলার প্রকান্ড মাঠ ও এলাকার পিকনিকের স্থল।

বাঁশ বাগানের মাথার উপর গোলাকার সূর্য। নিচে বিছিয়ে পড়ে থাকা বাঁশপাতার উপর মেলা বড় প্ল্যাস্টিক। তার উপর বসে একটি আস্ত পরগনা। বেলা যত বেড়েছে সংগঠনের বিভিন্ন বয়সী সদস্য ও সদস্যাদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। পাশে রাখা বাজারের ভারী ব্যাগ। ধুয়ে রাখা মাংসের উপর টক দই ও মশালা মিশিয়ে রাখা। গ্যাসের চুলায় রান্না করছেন নব্য গৃহিণী। পরিমার্জিত শব্দের কোনও বালাই নেই। ঠাট্টা করবার মাঝেই সহযোগিতা করে চলেছে কয়েকজন। গরম পকোড়া, ফ্রায়েড রাইস, চিকেনের পদ, চাটনি, পাঁপড়। গরম কড়ায় আওয়াজ তুলে রান্না তখন সপ্তমে। ছোটদের ডিসকাস খেলা, বড়দের গল্পগুজব আর পড়ুয়াদের দু'চোখ নদীর শীতল জলে। পাশে বাঁধা নৌকা। পা ঝুলিয়ে নদীর জল মেখে নেওয়া। 

কমলালেবুর খোসা ছাড়ানো শীতে দামোদরে পিকনিক। সেলফির ছড়াছড়ি থাকবে না তা কি করে হয়। চুলের স্ট্যাইল পরিবর্তন করে, আড় চোখে, মুখটা একটু বাঁকিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে খোশ মেজাজে ক্লিক করছে নেটিজেন। দূরে বক্সের রেগুলেটর জোড়ে দিয়ে উদ্দ্যাম নাচে বিহঙ্গ একদল যুবক-যুবতী। তাতে এদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। পাতা উল্টে কবিতা গুচ্ছ পড়বার ন্যায় নিজেদের মত করে মেতে উঠেছে সকলে। না না এ পাড়ায় বাঁশ বাগানে ভূত থাকে না। পাতার ফাঁক গলে মাঝেমধ্যে সূর্যের উঁকি ঝুঁকি। শীতের পাখি গুলো এসে দেখা দিয়ে যায়। ফোর জি সিগন্যালে বৃষ্টি বিঘ্নিত ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের লাইভ ভিডিও দেখে নেওয়া। 


উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ


কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র একসময় এখানকার চতুষ্পাঠীতে পড়াশোনা করেছেন। এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে অনেককিছু জানতে পারবেন, যেতে পারেন তাজপুরে ভারতচন্দ্রের মামা বাড়িতে। আগেকার রায় বাড়ির প্রভাব লোকমুখে এখনও ছড়িয়ে। স্মৃতিচিহ্ন বলতে একটি বিশালাকার পুকুর রয়েছে। পাবেন বেশকিছু পুঁথিপত্র। এখনও পূর্বের রীতি মেনে অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপুজো। 

এখানে পিকনিকে একটা অভিনবত্ব পেতেই পারেন। থার্মোকল এড়িয়ে এলাকার মানুষ শাল পাতাতেই বেশি উৎসাহ।
ত্রিপলের উপর বসে শাল পাতায় ফ্রায়েড রাইস ও চিকেনের স্বাদ চেটেপুটে খাবার মাঝেই দূরে পাত্রে চাটনি এবং সাজানো পাঁপড়। এলাকার জনপ্রিয় নলেন গুঁড়ের রসগোল্লা মুখে লেগে থাকা স্বাদ বেশ কিছুদিন জানান দেবে।খাওয়া শেষে রোদে গা মাখতে মাখতেই ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে পৌঁছে যাওয়া। নদীর মোটা পাড়ে ঢালু গায়ে গরু, ছাগল নিয়ে গ্রাম্য মানুষদের বসতি। ছোট পুকুরে জিওল মাছের টুপটুপ ডুব দেওয়া দেখার ফাঁকেই দূরে তাকিয়ে দেখলেন বেশ কিছু হনুমানের দৌড়ঝাঁপ। মোবাইলের ক্যামেরায় সে দৃশ্য ধরে রাখলেন। তারপর পৌঁছে গেলেন কয়েক'শ মিটার দূরে নদীর পাড়ে সাজানো গোছান কালীমাতার আশ্রম। 

সুদৃশ্য শ্বেত পাথরের মন্দির। বাগান ভর্তি গোলাপ রূপের চাউনিতে গা দোলাচ্ছে। পাশে কিশোরী ডালিয়া, ফুটবার অপেক্ষায় রূপশ্রী চন্দ্রমল্লিকা। নস্টালজিয়া কসমস ক্যালেন্ডুলা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। অসম্ভব সৌন্দর্যের রূপ নিয়ে অপেক্ষায় গাঁদা। সমস্তটা ক্যানভাসে ভরে নেবার মাঝেই পশ্চিম আকাশে ঢলতে থাকা কমলা রঙা সূর্য জানান দিচ্ছে এবার ফিরে যাবার সময় হয়েছে। দামোদর ছড়িয়েছে সন্ধ্যার কুয়াশা। 
অনেকটা সময় কাটিয়ে, বন্য জন্তুদের শব্দ কানে নিয়ে, মুক্ত অক্সিজেন বুক ভরে চললেন নিজের এক চিলতে সাজানো কুটিরে। একটা গ্রাম বাকি একটা পরগনায় বাজছে শঙ্খের ধ্বনি। আপনি এগিয়ে চলেছেন অন্ধকার রাস্তায় হেডলাইট জ্বলা গাড়িতে। আর মন গুনগুণ করে বলছে, 
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়।
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে......



©-কল্যাণ অধিকারী

Comments

  1. অসম্ভব সুন্দর। পিকনিকের সেরা পাওয়া

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

গল্প যখন সত্যি তৃতীয় পর্ব

শরৎচন্দ্রের বাড়ি একদিনে'র গন্তব্য