গল্প যখন সত্যি তৃতীয় পর্ব


|সমবয়েসি চিন্তায় একুশে পার, ধরা পড়েছি ওর চাউনি তে |


-কল্যাণ অধিকারী
পাশ কাটিয়ে যাবার অছিলায় কনুইয়ের ছোঁয়া ঠিকিয়ে যাবার চেষ্টা। যে মেয়ে চাঁদের আলো বিছিয়ে পড়া পথ দেখে বড় হয়েছে, দূর্বা ঘাসে শিশিরকণা হাতে ঘসে কাবাডি খেলেছে, কবিতা লিখে শতকাজে ব্যস্ত মাকে শুনিয়ে গালে হাম্পি আদায় করিয়েছে। অতটা সহজ ছিল না গচ্ছিত রাখা যতনের ধন কে স্পর্শ করতে দেওয়া। দিনের বেশিটা সময় সামনের কম্পিউটারে দু চোখ নিবন্ধ। কাজের মধ্যেও ছিল মোবাইলে নজর। ঘরে চিন্তিত মা, কাজে ব্যস্ত বাবা নতুন অফিসে শ্যামাঙ্গিনী মেয়ের সময়ে-অসময়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে। হয়তো আতিশয্যে থাকা কাবুলিওয়ালা খোকি এবার থেকে শহরের অফিসে দশটা পাঁচটা ডিউটি দেবে।
ফিরবার আগে লিফটের কাকু কে হাত বাড়িয়ে থামতে বলে প্রবেশ করে। কয়েক সেকেন্ডের কথা মিটিয়ে রাস্তায় পা ফেলা। কলেজ মোড়ের ব্যস্ততা ওকে থমকে দেয়। এ শহর কতো দৌড়ঝাঁপ করে। বাসের চাকায় মানুষের ধুকপুকে হৃদয় আটকে। চা, পান-বিড়ি, ঘুগনির দোকান, জুতো পালিশ করা বিহারের লোকটি সবাই চঞ্চল। মেসে ফিরবার বাসে ওঠে৷ ঝাকুনি দেওয়া বাসে কোলের সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে তাকিয়ে দেখে। কেউ দেয়নি সিট। এই শহর কারপূর্নের শহর। যেটুকু পায় ধরে রাখতে চায়। শেষ হবার আগে পর্যন্ত।


প্রীতির অফিসে রবিবার ছুটি। রাতে বারান্দার গ্রিলের গেট খুলে চেয়ার নিয়ে বসে। শনিবারের রাত একটু বেশি অবধি মানুষ রাস্তায়। দু'চোখ উঁকি দিয়ে তাকিয়ে। ঘরের দুজনের কোন আওয়াজ নেই। বোধহয় কিছু গোপনীয়তা বজায় রাখছে। সেরাতে হঠাতই চোখ পড়ে মেসের সামনের রাস্তায়। দুজন তারুণ্য বাইক নিয়ে বার কয়েক ঘোরাঘুরি করছে। সবকিছুই ঘটছে চোখের সামনে। টিনা'র ফোনেটিক চালু হয়েছে বোধহয়। তৃষ্ণা বাথরুমে গেল। বেসিনের কল খুলে জল পড়বার শব্দ ভেসে আসছে। কিছু পরেই ছাদে চড়বার আওয়াজ পেলাম। ঘরের দরজা খোলা। না এদের বোধহয় কিছুই বোধগম্য নেই।
মাঝে মাঝেই মনে হয় এই শহরে থেকেও আমি কেমন যেন একা। কবিতার পাতায় শুধুমাত্র চোখ চালিত হয়। শরীর ও মন আটকানো সেই আসানসোলে। এদিকে ঘড়ির কাঁটা মাঝরাত ছুঁয়েছে। ওদেরও কোন সাড়াশব্দ নেই। ছাদে উঠবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে অসুবিধা না হলেও ওরা কোথায় এই ভয় চেপে বসেছে। সামনে শূন্য একরাশ কৌতূহল আকাশ। তারাদের ভিড়ের মাঝে পাশের এপার্টমেন্টে আলোর দপদপানি। দূরে দুই সমবয়সী মেয়ে মধ্যবর্তী রিলেশনে মগ্ন। ইউটিউব এর দোরগোড়ায় চেনাজানা পণ্য দুই মেয়ের শরীরে বইছে। অষ্টাদশী দুই কন্যে যৌবন সঙ্গমে ভাসছে। ছিটেফোটা আলোয় দুজনের আবৃত শরীরে রেসিং গেমসের ছোবল।
এ শহরের কতগুলো রাত ও অনেকগুলো দিনের আলো দেখা হয়েছে। প্রখ্যাত কফি হাউসের চোখের ঈশারা আমাকেও ডেকেছিলো। সিঁড়ি বয়ে উঠে চলেছি। দেওয়ালে আটকানো কতো মা'ও গন্ধ্যের চিঠি। উপরে পাতা চেয়ারে বসে তাকিয়ে আছি ইতিহাসের পাতায়। উড়ে আসা সিগারেটের গন্ধটা আজ বড্ড চেনা। মেসের রুমে প্রতিরাতে ভেসে বেড়ায় ওই বেয়াদবী ধোঁয়া। অফিস টি বদলানোয় এখন সহজ হয়েছে জীবনের কথাগুলো। সেদিন চোখের জল শরীরের আবেগের কাছে পরাস্ত হয়েছিল। নামবার সময় লিফটের কাকু একটা মোবাইল নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। পরেরদিন নতুন ঠিকানায় পৌঁছাতে অবাক। ওই কাকু আমাকে মেয়ে পরিচয় দিয়ে কাজের কথা বলেছিলেন। এ শহরে পরিচিত সার্ভিস মেলে ঢাকখোলা অফিস থেকে। যৌবন খেলায় লোমশ ঘৃণা এখানে অগ্রাহ্য। বিদ্যমান মানুষকে সার্ভিস দেবার কথা শুনে আঁতকে উঠেছিলাম। এসবের গাইডলাইন আমার কাছে অবান্তর। ব্রাহ্মণ পাড়ার মেয়ে আমি কাজ ছেড়েছি বেতন ফেলে রেখে।

সমবয়েসি চিন্তায় একুশে পার করেছি। ধরা পড়েছি ওর চাউনি তে। প্রতি রাতে এখন ওকে খুঁজি। এ যেন আগুনের গোলায় নিজেকে ডোবানো। পরিপূর্ণ প্রেমে অগস্টের বিপ্লব। হ্যাঁ আমি শ্যামাঙ্গিনী প্রীয়া এক ছোড়ার প্রেমে পড়েছি। সে দিন দুপুরের শিফট শেষ করে ফিরছি বাসে। হাতের মোবাইলে গেম খেলছি। একটি ছেলে সমানে বলে চলছে। নদীয়ার বাদাম পাটালি। দাদা খেয়ে দেখবেন একদম মচমচে। একটা বাদামও খারাপ পাবেন না। বাড়িতে বানানো গাড়িতে বিক্রি। ওর কথাগুলো আমাকে আকর্ষণ করছে। ছবির মতো কালো দুটি চোখ। বয়সে চব্বিশের গোড়ায়। শরীরে খেটে খাওয়ার ইচ্ছে। মিনিট দশেকের বিক্রি শেষে বাড়ির ট্রেন ধরবে বলে ওই বাসেই চলেছে। পাশে বসতেই জিজ্ঞাসা করলাম নামটা। বললো সায়ন। কি অপূর্ব মেঠো চাউনি। ফোন নাম্বার টা নিয়েই নিলাম।
হ্যাঁ আজ ওর সাথেই এসেছি কফি হাউসে। ও পাটালি বিক্রি করে। গায়ে লেখা ও একজন হকার। খেটে খাওয়া মানুষ। বাড়িতে ফাইলে রাখা এম.এ পাশের সার্টিফিকেট। ইচ্ছে ছিলো প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করবার। একরাতেই জমাটি স্বপ্ন এলোমেলো হয়ে যায়। সন্ধ্যে বেলায় শরীর খারাপের জেরে ভোররাতে বাবার মৃত্যু। সকালে মায়ের শাঁখা ভেঙে দেবার শব্দ সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। ওর কথাগুলো রাতকে একটু বেশি জাগিয়ে তোলে। নিস্পাপ ঠোঁট নেড়েচেড়ে বলা কথাগুলো জোনাকির আলো দেয়। শিরশিরানি দেয় শরীরে। আটকে রাখতে পারি না নিজেকে। এই শহরে চপ মুড়ির গল্পে কতো হকার এম এ, পিএইচডি কেউ সন্ধান রাখে না।
©-কল্যাণ অধিকারী

Comments

Popular posts from this blog

শরৎচন্দ্রের বাড়ি একদিনে'র গন্তব্য

শান্ত দামোদর, পাখিদের কলকাকলি, বাড়তি পাওনা ভারতচন্দ্রের কাব্যতথ্য