এক গ্রাম্য পটচিত্র।।।


সময় যেখানে হাত ধরে ডাক দেয় 

-কল্যাণ অধিকারী

ওই যে বড় গাছটার মাথা দেখা যাচ্ছে ওখানেই কুঁড়েঘর। ঘরের এককোনে ইষ্ট দেবতাকে সঙ্গে নিয়ে বাস করে মায়া। একগন্ডা ছাগল, কিছু বালিহাঁস, একজোড়া গরু, কাটা ছটাক জমি নিয়ে সংসার। হ্যাঁ আর আছে হার চিরচিরে মিনসে।
কয়েকক্রোশ দূরে মোড়লের জমিতে দিনের শ্রমটুকু দিয়ে ঘরে ফেরে। মায়ার কাজ সকালে গামছায় মুড়ি, পিঁয়াজ, গাছের লঙ্কা বেঁধে দেওয়া। বাকি সময় ঘরের সদস্যদের জমিতে চড়িয়ে আনা। ইঁদুরের দল গাঁয়ের মোড়লের জমির ধানের শিষ কেটে গর্ত করে মাটির ভিতর নিয়ে যায়। হয়ত মায়ার জন্য। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে জমির ধান বের করে আনে মায়া।



সূর্য মাথার উপর উঠলে ঘরে ফেরা। ভাত ফোটাতে হবে। মিনসে কাজ করে ফিরে মুখে তুলবে। রোদে থেকে পিঠ পুড়িয়েছে তবুও বাবুর একবিন্দু বিশ্বাস ভাঙেনি।
কিজানি বেলা যে কত হল! কুয়াশা কেন যে ওঠে বেলা অবধি সূর্য দেখতে পাইনি। মিনসেটা কখন যে চলে আসে। ছাগল নিয়ে ঘরমুখো মায়া। নিতাইদের মেয়েটার আজ বিয়ে। ওরা বিয়ে বাড়ির অবশিষ্ট খাবার গুলো নিয়ে আসতে বলেছে। কতদিন পরে একটু মাছের টুকরো মুখে তুলব। সেবার দু-গন্ডা মাছের চাকা দিয়েছিল। তার উপর এই সাইজের সরু চালের ভাত। মিষ্টি কত।
তখন ঠিক মতন কাপড় পড়তেও জানতুম নি। চারহাত এক করে দিল বাবা। সেই থেকে আজ অবধি বার তিরিশেক মনসাপূজো দেখলুম। কতবার যে রাতে না খেয়ে শুধু মাটির ঘটের জল খেয়ে রাত কাটিয়েছি তার হিসেব নেই।
এখন তো কন্ট্রোল থেকে চাল পাই সেটাই ফুটিয়ে খাই। রাতে ছাগল-গরুর দুধ গরম করে রুটি দিয়ে মেখে দিই। জানো বাবু আমাদের গাঁয়ে আর বনরাজারা আসেনি।



উঠানের কোনে শ্বশুর কে প্রদীপ জ্বেলে দিই। আজ অবধি কখনও মুখপোড়া গায়ে হাত তোলেনি গো। বছরের শেষে হাটে ছাগল বিক্রি করে যা আসে তা দিয়ে দিন চলে যায়। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি পাঁচ ক্রোশ দূরে। এবার ছাগল বিক্রি করে বলেছি নাতনিকে একটা কানের কিনে দেব।
গ্রামের মানুষ বলছে এবার নাকি মনসা পুজোয় দু'রাত যাত্রা হবে। মেয়েটাও আসবে। বলুনি যেন ওই যে মোড়ল আছে ওর বাড়িতে আগে সব ডাকাতরা আসত। লেঠেল ছিল। আমার শ্বশুর রাত বুঝতে না পেরে উঠে হাটে যাচ্ছিল মাঠে লেঠেলরা ফেলে কি মারটা না মেরেছিল। সেই যে পড়লো আর সোজা হতে পারলুনি। একদিন মরে গেল। দশ টাকার পাঁচটা নোট মিনসের হাতে গুঁজে দিয়েছিল। ওদের ভয়ে রায়বাঘিনী তলায় আগে কেউ যেতুনি। রাত কিগো দিনের আলোতেও যেতুনি। ওদের আর কেউ নেই সব পক্ষাঘাতে মরেছে। ভগবানে নিয়েছে। ওত পাপ করলি হবে ভুগতে হবেনি।
না গো আর কথা বলা যাবেনি। মিনসেটা চলে আসবে। আজ আবার চাল পাছুরতে হবে। উনুনে কাল মাটি দিয়েছি একটু ভিজেভিজে আছে। ঘুঁটে তুলতে হবে। গরুটার বাছুর হবে। বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলতে থাকল মায়া।


যদি যেতে চান বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে। আর প্রাণ খুলে ওঁদের কথা শুনতে তাহলে বলবেন ঠিকানা দিতে পারি।
-কল্যাণ অধিকারী

চিত্র গুগল প্রাপ্ত। 

Comments

Popular posts from this blog

গল্প যখন সত্যি তৃতীয় পর্ব

শরৎচন্দ্রের বাড়ি একদিনে'র গন্তব্য

শান্ত দামোদর, পাখিদের কলকাকলি, বাড়তি পাওনা ভারতচন্দ্রের কাব্যতথ্য