চতুর্থ পর্ব




|সাঁওতালি পিঠে প্রেমের পরশ টানে শশাঙ্ক|
-কল্যাণ অধিকারী
ঘড়িতে তখন দু'টো। উল্টোডাঙ্গা মোড় বেশ কিছুটা ফাঁকা। হনহন করে এগিয়ে চলেছে প্রীয়া। অটো ধরে প্রথমে কেষ্টপুর। ওখানে ডকুমেন্ট দিয়ে ফিরে আসতে হবে দমদম। কাজ মিটিয়ে আবার অফিস।ঠাসা সিডিউল। অটো'র পিছনের তিনজনের সিটে দু'জন মানুষ দেখে বাকি জায়গায় বসে যায়৷ পাশের ভদ্রলোক বার কয়েক মুখপানে তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। শহুরে স্মার্ট মেয়েদের মতো ছোঁয়া নেই বলে হয়তো! পকেট থেকে মোবাইল বের করবার প্রচেষ্টায় আসানসোলের শ্যামাঙ্গিনীর কোমরে হাত ঘষতে তো অসুবিধা নেই! ওই কাজটায় বেশ পটুত্ব বোঝা গেল।
আঙুলের নোখ পরিমাপ করে কাটা হলেও চেষ্টা করলে আঁচড়ে দিতে পারবে প্রীয়া। বোধহয় বুঝতে পেরে হাতকে সামলে নিয়েছেন। শ্রীভূমি পার করে কেষ্টপুর পৌঁছে যায় অটো। ভাড়া মিটিয়ে ডাকাবুকা পাড়া ধরে এগিয়ে চলেছে। একতলার ফ্ল্যাটে ডকুমেন্ট দিয়ে ফিরবার বাস। হন্তদন্ত হয়ে চলায় হালকা শীতের মধ্যেও ভিজেছে বগল। অভ্যস্ত না হলেও সেবার কলেজ থেকে সমক্লাসের ছেলে মেয়েরা মিলে গিরিডি গিয়েছিল। প্রাণান্তকর ধূলোর আস্তরণ পার করে জঙ্গল ঘিরে থাকা নদীতে পাথরের অনুসন্ধান চালানো হয়। ভূগোল প্রেম বরাবরের। সেই থেকেই পাখর খুঁজে চলা।
নদীর স্বচ্ছ মাপা জলে হাঁটু ডুবিয়ে বাসপি'কে ভেজানোর প্রয়াস। টানটান শরীরে বসন্তের বায়লেখা। এঁকে বেঁকে চলা নদীতে মন চাইছে ডুব দিতে। ভিজুক না হোক শরীর। অষ্টাদশী মেয়ের ভ্রু প্লাক করা দু চোখে তখন আষাঢ়ে প্লাবন। প্রকৃতি যেন ঠেলে দিচ্ছে তার মস্ত শরীর। প্রবল তাড়না তে শুষে নিচ্ছে গোটা দেহ।দিনের আলো ঢলতে শুরু করেছে। প্রকৃতিকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার শরীর। দিনের অধিকাংশ সময় ছিল খুড়িয়ে চলা ছোট্ট কুকুর ছানা। বিকেলের ইতি টেনেছে অথচ ওর পরিবারের কাউকে সকাল থেকে একটিবারের জন্য দেখতে পাওয়া যায়নি। খুড়িয়ে চলায় পরিবার ছুট হয়ে পড়েছে। নদীর খাদে ফেলে আসতেও মন চায়নি। লুকিয়ে বাসের ভেতরে ওকে নিয়ে প্রবেশ করে প্রীয়া।
ফোনটা বেজে উঠতেই সঙ্গত ফিরে আসে। আপনি কোথায় আছেন? আমি রাস্তায় অপেক্ষা করছি। আধো হিন্দি টানে বলে চলেন মিস্টার বোথরা। একতলার অফিসে বসে কাজের সমস্তটা মিটিয়ে নেওয়া। পরের গন্তব্য দমদম। কাজ মিটিয়ে দিনান্তে ফিরে আসবার প্রয়াস। দমদম থেকে ট্রেনে শিয়ালদা পৌঁছে মনে ইচ্ছে জাগে গল্পগুচ্ছ কিনবার। কলেজস্ট্রীট পৌঁছে দুমুখো দোকানের মাঝের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে। বঙ্কুদার দোকান থেকে বই কিনে আদি মোহিনী মোহনের সামনে দাঁড়িয়ে। পাশে লাল রঙের কাঞ্জিলাল শাড়ী পড়ে মডেল। অগ্রহায়ণ মাসের মস্ত বিয়ের মাসের চলছে কেনাকাটার ধুম। মেয়ের হাতে পছন্দের বেনারসি। শ্বশুর বাড়ির তত্ত্বের কেনাকাটা সেরে বাড়ির পথ ধরেছে গৃহকর্ত্রী। হঠাতি চোখ যায় সামনের বাসে। আরে শশাঙ্ক না! হাতের প্যাকেটে বাদাম পাটালি ভরে বিক্রি করছে। সেই চেনা সুর। রাস্তা পার করে উঠ পরে বাসে।
একরাশ লম্বা লাইনের আগে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ সিগন্যাল। মানুষের বিরক্তি ওর বিক্রিতে বান ডাকে। সাবলীল বাংলায় বলে চলেছে বাদাম পাটালির বিজ্ঞাপন। বেশ লাগছিল ওকে। ছোট ছোট করে কাটা চুলে মাথাটা অনেকটা হাল্কা। পরিবারের চাপ সহ্য করে এগিয়ে চলেছে বসতি গড়ে তুলতে। সামনের দিকে তাকিয়ে বিক্রি করে চলেছে। শশাঙ্কর অন্তরে খেটে খাওয়ার চেতনা। ওকে এগিয়ে নিয়ে যাবে শ্যামাঙ্গিনীর ভালোবাসা। নেমে যাওয়ার আগে সরল চোখ পড়ে প্রীয়ার পানে। অবাকই হয়ে যায়। অডি কিংবা সুইফট গাড়ি নেই, লোকাল বাসে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে বাদাম। দূর থেকে লজ্জা মাখা হাসি দেয়। প্রীয়া এগিয়ে আসে ওর কাছে।
বাস থেকে নেমে যায় দু'জনে। কি গো আজ বিক্রি কেমন হয়েছে? এই আমিও একটা বাদাম পাটালি কিনবো! হাসি মুখে একটি দিতেই আর একটির আবদার। চলোনা আজ কোথাও গিয়ে একটু বসি। এই কফি হাউস যাবে? কিন্তু ওখানে তো হাত ব্যাগ নিয়ে যাওয়া মানায় বলো। আচ্ছা তাহলে চলো লেকের ধারে বসি। হ্যাঁ সেটাই ভালো। বই পাড়া ছেড়ে এগিয়ে চলে কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অপর প্রান্ত ধরে। লেকের পাশে সাজানো চেয়ারে দুজনে পাশাপাশি। শশাঙ্ক তুমি-আমি একটা আস্ত পৃথিবী গড়তে চাই। যেখানে বইবে কলতান দেওয়া নদী। টানা স্রোতে ভেসে যাব আমরা। ওর দু'চোখ ভরে যায় জলে। হকার ছেলের প্রেমে কোনও এক অচেনা লহমা। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বসে থাকে। আঙুলের ফাঁকে থাকা কলমের দাগ মুছে বাদাম পাটালি হোক পেট তো চলে। তোমার পরিবারের মাঝে আমার পরিচয় বড্ড বেআক্কেলে ঠেকাচ্ছে। কথাগুলো শুনে মুখ নামিয়ে নেয় প্রীয়া।
আকাশের অন্ধকারের মাঝে ওষ্ঠে রাঙা অভিমান। টানা চোখের চাউনিতে বিরহব্যাথা সহনে-স্বপনে সমাপৃত। চিতোল সাঁওতালি পিঠে নবান্নের অমাবস্যা। মনে পড়ে যায় যৌবনের মধ্যাহ্নে দোল খাওয়া কিশোরের একমুঠো স্মৃতির মত। সময়ের স্রোতে ভেসে বেড়ায়।
নাই বা টানলে চোখে কাজল, কপালে লাল রঙের টিপ। তবুও আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকা আম গাছের ঝিঁ ঝিঁ পোকার দিকে। কপালের মধ্যপানে শশাঙ্ক চুমু দেয়। আকর্ষণে আটকে যায় দুই চরিত্র। শরীরের কথা ভুলেছে আবেগী মন। উষ্ণতায় শহরের পাদপদ্ম একাত্ম। সে রাতে খাওয়ার পরে মায়ের কাছে প্রীয়া'র বিষয় উঠে আসে। দিন-রাতের সংসারে জমে না কিছুই তবুও শ্যামাঙ্গিনী প্রীয়া রাজ নন্দিনী। প্রদীপের শিখা উজ্জ্বল রূপ নিয়েছে। ফোনের ও পারে প্রীয়া এটার অপেক্ষায় চোখ মুছছে।
রাতের ঘুম সেরে সাত সকালে বাড়ি ফিরবার গাড়ি ধরে। শ্যামলী বাসে ধর্মতলা থেকে সোজা আসানসোল। ওখান থেকে ম্যাজিক চড়ে এগিয়ে চলে গ্রামের বাড়িতে। ক'দিন পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরতে হবে। পাশের বাড়ির সোনালী দিদি এসেছে। ওর সাথে কতদিন পর দেখা হবে। তবে সবথেকে বড় শশাঙ্ক। ওর জন্য বড্ড ইচ্ছে জাগে। ওই কংক্রিটের শহরে মন খুলে ভালোবাসা'র কথা বলা ছেলে পেয়েছে। অর্থ নাইবা রইলো হৃদয় তো পেয়েছে। দু'জনের লড়াইয়ে এক স্বপ্ন জেগে উঠবে। উঠোনে জুতো খুলে ঘরে ঢুকতেই মা পুজো করছে। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে ঘটে জল দিয়েছ তো? ওগো দেখো বাড়িতে কে এসেছে! দিগন্তের ডাকে আম্রপল্লব ঝরে পড়ে। বিকেলে মাঠে সরু আল ধরে ঘুরে বেড়ায়। তাকিয়ে থাকে পাকা ধানের শীষ ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়া টিয়ার পানে। আসলে সবকিছু ঠিক হবে শশাঙ্ক যদি এ বাড়িতে আসে। সন্ধ্যের শেষে বাড়িতে এ'কথা বলতেই অবাক হয়ে যায় পিতা। তোর চোখ সবসময়ই ভালো জিনিসটায়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি রে। তবে ওকে বলিস আমার এই শ্যামাঙ্গিনী মেয়ের ভালোবাসায় আমাদের সম্মতি সর্বদা থাকবে।
©-কল্যাণ অধিকারী
বাকিটা পরবর্তী পর্বে।
চিত্র গুগল।

Comments

Popular posts from this blog

গল্প যখন সত্যি তৃতীয় পর্ব

শরৎচন্দ্রের বাড়ি একদিনে'র গন্তব্য

শান্ত দামোদর, পাখিদের কলকাকলি, বাড়তি পাওনা ভারতচন্দ্রের কাব্যতথ্য